কেনিয়ার প্রখ্যাত পরিবেশবিদ
ও নারী আন্দোলনের কর্মী ওয়াঙ্গারি মাথাইয়ের মৃত্যুর খবর ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১১ প্রচারিত হওয়ার পর সারা
বিশ্বে শোক নেমে আসে। ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ৭১ বছর বয়সে এই মৃত্যু ঘটলেও তাঁর
মতো একজন মানুষের জন্য এটা অকালমৃত্যুই বলা যায়। কারণ, তাঁর
এখনো অনেক কাজ করার ছিল। তাঁর কাজের গুরুত্ব সারা বিশ্বে ছড়িয়ে আছে।
কঠিন সমস্যার সহজ সমাধান কী করে করা যায়, তা ওয়াঙ্গারি মাথাই করে দেখিয়েছেন। ১৯৭৬ সালে তিনি যখন কেনিয়ার জাতীয় নারী পরিষদে (ন্যাশনাল কাউন্সিল অব উইমেন) ছিলেন, তখন থেকেই তাঁর মাথায় সামাজিকভাবে গাছ লাগানোর চিন্তা এসেছিল। বিদেশে লেখাপড়া করে ডক্টরেট ডিগ্রিধারী হলেও কেনিয়ার গ্রামেই তাঁর বেড়ে ওঠা, প্রকৃতিকে খুব কাছ থেকেই তিনি দেখেছেন। মাটির গন্ধ তাঁর কাছ থেকে যায়নি। পড়াশোনাও করেছেন প্রাণিবিদ্যা নিয়ে। অধ্যাপনার পাশাপাশি কেনিয়ার নির্যাতিত নারীদের জন্য কাজ করছিলেন। এই সময় তিনি দেখলেন কৃষকদের ফসল উৎপাদন থেকে বিরত রেখে রপ্তানির জন্য অর্থকরী ফসল চা ও কফি উৎপাদন করতে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। বন উজাড় করে চা-কফির উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে। এতে কৃষক খাদ্য উৎপাদন করতে পারছে না। নারীরা এতে খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং শিশুরা অপুষ্টিতে ভুগছে। মাটির উর্বরতা নষ্ট হয়ে গেছে, গবাদিপশুর খাদ্য নেই, রান্নার জন্য খড়ি নেই, খাওয়ার জন্য পানি নেই। এত ব্যাপক সমস্যার একটি সহজ সমাধান বের করলেন ওয়াঙ্গারি: গাছ লাগানো। গাছ খাদ্য দেবে, গাছ রান্নার খড়ি দেবে; গাছের মাধ্যমেই মিলবে এই বড় সমস্যার সমাধান।
একপর্যায়ে গ্রিন বেল্ট মুভমেন্ট প্রতিষ্ঠা করে গ্রামীণ নারীদের জীবন-জীবিকার জন্য গাছ লাগানো, পরিষ্কার পানির ব্যবস্থা করা, রান্নার জন্য খড়ির ব্যবস্থা করার মতো সহজ কিন্তু অতি জরুরি কাজটি ওয়াঙ্গারি করেছিলেন। তাঁর এই আন্দোলনের মাধ্যমে কেনিয়াতে সাড়ে চার কোটি গাছ লাগানো হয়, প্রায় নয় লাখ নারী চারার নার্সারি করে, গাছ লাগিয়ে মরুময়তা রুখতে পেরেছিলেন, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পেরেছিলেন। শুধু গ্রামীণ নারীদের মাধ্যমেই নয়, গির্জা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও তাঁর গাছ লাগানোর কাজ ছড়িয়ে পড়েছিল। ১৯৮৬ সালে গ্রিন বেল্ট মুভমেন্ট আফ্রিকার অন্যান্য দেশের নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং তানজানিয়া, উগান্ডা, মালাবি, লেসোথো, ইথিওপিয়া, জিম্বাবুয়ে প্রভৃতি দেশও গাছ লাগিয়ে মরুময়তা রোধ করার উদ্যোগ নেয়।
আফ্রিকার এই নারীর মৃত্যুর খবর বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের কর্মী বা পরিবেশ আন্দোলনের কর্মীরা ছাড়া অন্যরা কতখানি তাঁর বিষয়ে অবগত আছেন, তা বোঝার উপায় নেই। পত্রপত্রিকার খবর দেখলেও একটু হতাশ হতে হয়। বিশ্ববিখ্যাত গায়ক মাইকেল জ্যাকসন কিংবা ক্রিকেট খেলোয়াড় নবাব পতৌদির ব্যাপারে যত জানা যায়, ওয়াঙ্গারি সম্পর্কে ততটা নয়। এটা আমাদের জন্য দুঃখজনক। পরিবেশ রক্ষার মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি ২০০৪ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন। তিনিই আফ্রিকার প্রথম নোবেলবিজয়ী নারী। এটা গুরুত্বপূর্ণ বটে, কিন্তু তাঁর কাজ এর চেয়েও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। নোবেল পুরস্কারের বেলাতেও কেউ কেউ সমালোচনা করেছিলেন, শুধু গাছ লাগিয়ে কী করে একজন নোবেল শান্তি পুরস্কার পেতে পারেন! কোটি কোটি গাছ লাগিয়ে যিনি দেশকে ভয়াবহ খরা ও মরুময়তা থেকে রক্ষা করলেন, তার মূল্যায়ন করতেও অনেকের দ্বিধা ছিল।
ওয়াঙ্গারির গাছ লাগানোর কাজ এত ছড়িয়ে গিয়েছিল যে জাতিসংঘ ২০০৬ সালে বিশ্বব্যাপী ১১ বিলিয়ন গাছ লাগানোর কর্মসূচি নেয়। যাঁরা ওয়াঙ্গারির গাছ লাগানোর ব্যস্ততা দেখেছেন, তাঁরা মন্তব্য করতেন, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ভিআইপিদের দিয়ে গাছ লাগাতে গিয়ে ওয়াঙ্গারিকে হাঁটু গেড়ে বসে কী করে গাছ লাগাতে হয়, তা দেখাতে হতো। তাই তাঁর হাঁটুতে কাদা লেগেই থাকত।
ওয়াঙ্গারি যেমন গাছ লাগিয়েছেন, তেমনি গাছের ব্যবহারের ক্ষেত্রেও তাঁর মতামত ছিল অনেক স্পষ্ট।
তিনি ২০০৪ সালে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরপরই প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন, মৃত্যুর পর তাঁকে যেন কাঠের কফিনে সমাহিত করা না হয়। তাঁর মতে, কাঠের কফিন বনের জন্য বড় ধরনের হুমকি। তাই ধারণা করা হচ্ছে, তাঁকে ভিন্নভাবে সমাহিত করা হবে, যদিও সেটা কী হবে, এই লেখা যখন লিখছি, তখনো জানা যায়নি। তাঁর এই বক্তব্যে কেনিয়ার সাবেক স্বৈরাচারী প্রেসিডেন্ট ড্যানিয়েল আরাপ মোই ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। ওয়াঙ্গারিকে তিনি পাগল নারী বলে আখ্যায়িত করতেও ছাড়েননি। কারণ, ওয়াঙ্গারির এই সহজ-সরল গাছ লাগানোর কাজটি দারিদ্র্য, সংঘাত দূর করার জন্য তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছিল, এমনকি ধনী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কেনিয়ার তৎকালীন সরকার ১৯৯৮ সালে সংরক্ষিত বনে তার রাজনৈতিক মিত্রদের জমি বরাদ্দ দেওয়ার উদ্যোগ নিলে ওয়াঙ্গারি জমি অধিকারের আন্দোলন শুরু করেন। তিনি সংঘাতপূর্ণ কিছুই করেননি, গাছ লাগিয়ে প্রতিবাদ করেন, কিন্তু তাঁর প্রতিপক্ষ তীর-ধনুক নিয়ে এবং অস্ত্রসজ্জিত হয়ে তাঁর ওপর হামলা চালায়। ওয়াঙ্গারি মাথায় আঘাত পেয়েছিলেন। এর আগে ১৯৯২ সালে তিনি রাজনৈতিক বন্দী সন্তানের মায়েদের নিয়ে অনশন করলে পুলিশি নির্যাতনের শিকার হন। অর্থাৎ, ওয়াঙ্গারির গাছ লাগানোর কাজ নিছক পরিবেশবাদী কাজ হয়ে থাকেনি, বরং গণতান্ত্রিক ও শান্তির সংগ্রামের প্রতীক হয়ে ওঠে।
সুষ্ঠু পরিবেশের জন্য গণতান্ত্রিক সরকার একান্তই জরুরি। কাজেই কেনিয়ার রাজনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে গাছ শুধু পরিবেশের জন্য নয়, গণতন্ত্রের প্রতীক হয়ে উঠল। ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি ও পরিবেশের অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে লড়তে হলেও গাছ বড় অনুপ্রেরণা জোগায়। ওয়াঙ্গারি এটা দৃঢ়তার সঙ্গে বিশ্বাস করতেন। ওয়াঙ্গারি পরিবেশ আন্দোলনের পাশাপাশি রাজনৈতিকভাবেও স্বৈরাচারী সরকারকে হটাতে সক্ষম হয়েছিলেন। উল্লেখ্য, তিনি ২০০২ সালের জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেন এবং ৯৮ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়ী হন। এই নির্বাচনে ড্যানিয়েল আরাপ মোইয়ের পতন ঘটে। নতুন প্রেসিডেন্ট কিবেকি তাঁকে পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন।
গাছ লাগিয়ে দেশের এত বড় সমস্যার সমাধান করা যাবে, এমন চিন্তা অনেকের কাছে হাস্যকর মনে হয়েছিল। কিন্তু ওয়াঙ্গারি প্রকৃতির সঙ্গে এতই একাত্ম ছিলেন যে বড় সমস্যা সমাধানের জন্য অতি ক্ষুদ্রকায় পাখি হামিং বার্ডের কাছ থেকেও শিক্ষা নিয়েছিলেন। ওয়াঙ্গারি একটি গল্প বর্ণনা করে নিজের কাজের গুরুত্ব সম্পর্কে বলতেন এভাবে: ‘বনে আগুন লেগেছে, আর হামিং বার্ড ঠোঁটে পানি নিয়ে এক ফোঁটা করে ঢালছে। তা দেখে বৃহৎ প্রাণী হাতির মন্তব্য, হামিং বার্ড অনর্থক তার শক্তি ক্ষয় করছে। উত্তরে হামিং বার্ড বিনয়ের সঙ্গে বলে, আমার সাধ্যে যা কুলোয়, ততটুকুই আমি করছি।’ ওয়াঙ্গারি বলতেন, ‘আমি হাতি হয়ে বসে বসে পৃথিবী ধ্বংস হচ্ছে দেখতে চাই না, আমি হামিং বার্ড হয়ে আমার পক্ষে যতটুকু সম্ভব ততটুকু করে যাব।’
নারী অধিকার রক্ষার আন্দোলনে জড়িত হয়েই, নারীদের সমস্যার সমাধান করতে গিয়েই ওয়াঙ্গারির গাছ লাগানোর অপূর্ব চিন্তা এবং কাজ আমরা দেখেছি। তিনি নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেও পরিবেশ রক্ষা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছিলেন। তিনি মনোযোগ দিয়েছেন রাজনীতিতে, পাশাপাশি নারীদের রান্নার খড়ি জোগানোর কথা ভোলেননি।
Source :
কঠিন সমস্যার সহজ সমাধান কী করে করা যায়, তা ওয়াঙ্গারি মাথাই করে দেখিয়েছেন। ১৯৭৬ সালে তিনি যখন কেনিয়ার জাতীয় নারী পরিষদে (ন্যাশনাল কাউন্সিল অব উইমেন) ছিলেন, তখন থেকেই তাঁর মাথায় সামাজিকভাবে গাছ লাগানোর চিন্তা এসেছিল। বিদেশে লেখাপড়া করে ডক্টরেট ডিগ্রিধারী হলেও কেনিয়ার গ্রামেই তাঁর বেড়ে ওঠা, প্রকৃতিকে খুব কাছ থেকেই তিনি দেখেছেন। মাটির গন্ধ তাঁর কাছ থেকে যায়নি। পড়াশোনাও করেছেন প্রাণিবিদ্যা নিয়ে। অধ্যাপনার পাশাপাশি কেনিয়ার নির্যাতিত নারীদের জন্য কাজ করছিলেন। এই সময় তিনি দেখলেন কৃষকদের ফসল উৎপাদন থেকে বিরত রেখে রপ্তানির জন্য অর্থকরী ফসল চা ও কফি উৎপাদন করতে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। বন উজাড় করে চা-কফির উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে। এতে কৃষক খাদ্য উৎপাদন করতে পারছে না। নারীরা এতে খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং শিশুরা অপুষ্টিতে ভুগছে। মাটির উর্বরতা নষ্ট হয়ে গেছে, গবাদিপশুর খাদ্য নেই, রান্নার জন্য খড়ি নেই, খাওয়ার জন্য পানি নেই। এত ব্যাপক সমস্যার একটি সহজ সমাধান বের করলেন ওয়াঙ্গারি: গাছ লাগানো। গাছ খাদ্য দেবে, গাছ রান্নার খড়ি দেবে; গাছের মাধ্যমেই মিলবে এই বড় সমস্যার সমাধান।
একপর্যায়ে গ্রিন বেল্ট মুভমেন্ট প্রতিষ্ঠা করে গ্রামীণ নারীদের জীবন-জীবিকার জন্য গাছ লাগানো, পরিষ্কার পানির ব্যবস্থা করা, রান্নার জন্য খড়ির ব্যবস্থা করার মতো সহজ কিন্তু অতি জরুরি কাজটি ওয়াঙ্গারি করেছিলেন। তাঁর এই আন্দোলনের মাধ্যমে কেনিয়াতে সাড়ে চার কোটি গাছ লাগানো হয়, প্রায় নয় লাখ নারী চারার নার্সারি করে, গাছ লাগিয়ে মরুময়তা রুখতে পেরেছিলেন, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পেরেছিলেন। শুধু গ্রামীণ নারীদের মাধ্যমেই নয়, গির্জা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও তাঁর গাছ লাগানোর কাজ ছড়িয়ে পড়েছিল। ১৯৮৬ সালে গ্রিন বেল্ট মুভমেন্ট আফ্রিকার অন্যান্য দেশের নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং তানজানিয়া, উগান্ডা, মালাবি, লেসোথো, ইথিওপিয়া, জিম্বাবুয়ে প্রভৃতি দেশও গাছ লাগিয়ে মরুময়তা রোধ করার উদ্যোগ নেয়।
আফ্রিকার এই নারীর মৃত্যুর খবর বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের কর্মী বা পরিবেশ আন্দোলনের কর্মীরা ছাড়া অন্যরা কতখানি তাঁর বিষয়ে অবগত আছেন, তা বোঝার উপায় নেই। পত্রপত্রিকার খবর দেখলেও একটু হতাশ হতে হয়। বিশ্ববিখ্যাত গায়ক মাইকেল জ্যাকসন কিংবা ক্রিকেট খেলোয়াড় নবাব পতৌদির ব্যাপারে যত জানা যায়, ওয়াঙ্গারি সম্পর্কে ততটা নয়। এটা আমাদের জন্য দুঃখজনক। পরিবেশ রক্ষার মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি ২০০৪ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন। তিনিই আফ্রিকার প্রথম নোবেলবিজয়ী নারী। এটা গুরুত্বপূর্ণ বটে, কিন্তু তাঁর কাজ এর চেয়েও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। নোবেল পুরস্কারের বেলাতেও কেউ কেউ সমালোচনা করেছিলেন, শুধু গাছ লাগিয়ে কী করে একজন নোবেল শান্তি পুরস্কার পেতে পারেন! কোটি কোটি গাছ লাগিয়ে যিনি দেশকে ভয়াবহ খরা ও মরুময়তা থেকে রক্ষা করলেন, তার মূল্যায়ন করতেও অনেকের দ্বিধা ছিল।
ওয়াঙ্গারির গাছ লাগানোর কাজ এত ছড়িয়ে গিয়েছিল যে জাতিসংঘ ২০০৬ সালে বিশ্বব্যাপী ১১ বিলিয়ন গাছ লাগানোর কর্মসূচি নেয়। যাঁরা ওয়াঙ্গারির গাছ লাগানোর ব্যস্ততা দেখেছেন, তাঁরা মন্তব্য করতেন, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ভিআইপিদের দিয়ে গাছ লাগাতে গিয়ে ওয়াঙ্গারিকে হাঁটু গেড়ে বসে কী করে গাছ লাগাতে হয়, তা দেখাতে হতো। তাই তাঁর হাঁটুতে কাদা লেগেই থাকত।
ওয়াঙ্গারি যেমন গাছ লাগিয়েছেন, তেমনি গাছের ব্যবহারের ক্ষেত্রেও তাঁর মতামত ছিল অনেক স্পষ্ট।
তিনি ২০০৪ সালে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরপরই প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন, মৃত্যুর পর তাঁকে যেন কাঠের কফিনে সমাহিত করা না হয়। তাঁর মতে, কাঠের কফিন বনের জন্য বড় ধরনের হুমকি। তাই ধারণা করা হচ্ছে, তাঁকে ভিন্নভাবে সমাহিত করা হবে, যদিও সেটা কী হবে, এই লেখা যখন লিখছি, তখনো জানা যায়নি। তাঁর এই বক্তব্যে কেনিয়ার সাবেক স্বৈরাচারী প্রেসিডেন্ট ড্যানিয়েল আরাপ মোই ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। ওয়াঙ্গারিকে তিনি পাগল নারী বলে আখ্যায়িত করতেও ছাড়েননি। কারণ, ওয়াঙ্গারির এই সহজ-সরল গাছ লাগানোর কাজটি দারিদ্র্য, সংঘাত দূর করার জন্য তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছিল, এমনকি ধনী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কেনিয়ার তৎকালীন সরকার ১৯৯৮ সালে সংরক্ষিত বনে তার রাজনৈতিক মিত্রদের জমি বরাদ্দ দেওয়ার উদ্যোগ নিলে ওয়াঙ্গারি জমি অধিকারের আন্দোলন শুরু করেন। তিনি সংঘাতপূর্ণ কিছুই করেননি, গাছ লাগিয়ে প্রতিবাদ করেন, কিন্তু তাঁর প্রতিপক্ষ তীর-ধনুক নিয়ে এবং অস্ত্রসজ্জিত হয়ে তাঁর ওপর হামলা চালায়। ওয়াঙ্গারি মাথায় আঘাত পেয়েছিলেন। এর আগে ১৯৯২ সালে তিনি রাজনৈতিক বন্দী সন্তানের মায়েদের নিয়ে অনশন করলে পুলিশি নির্যাতনের শিকার হন। অর্থাৎ, ওয়াঙ্গারির গাছ লাগানোর কাজ নিছক পরিবেশবাদী কাজ হয়ে থাকেনি, বরং গণতান্ত্রিক ও শান্তির সংগ্রামের প্রতীক হয়ে ওঠে।
সুষ্ঠু পরিবেশের জন্য গণতান্ত্রিক সরকার একান্তই জরুরি। কাজেই কেনিয়ার রাজনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে গাছ শুধু পরিবেশের জন্য নয়, গণতন্ত্রের প্রতীক হয়ে উঠল। ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি ও পরিবেশের অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে লড়তে হলেও গাছ বড় অনুপ্রেরণা জোগায়। ওয়াঙ্গারি এটা দৃঢ়তার সঙ্গে বিশ্বাস করতেন। ওয়াঙ্গারি পরিবেশ আন্দোলনের পাশাপাশি রাজনৈতিকভাবেও স্বৈরাচারী সরকারকে হটাতে সক্ষম হয়েছিলেন। উল্লেখ্য, তিনি ২০০২ সালের জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেন এবং ৯৮ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়ী হন। এই নির্বাচনে ড্যানিয়েল আরাপ মোইয়ের পতন ঘটে। নতুন প্রেসিডেন্ট কিবেকি তাঁকে পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন।
গাছ লাগিয়ে দেশের এত বড় সমস্যার সমাধান করা যাবে, এমন চিন্তা অনেকের কাছে হাস্যকর মনে হয়েছিল। কিন্তু ওয়াঙ্গারি প্রকৃতির সঙ্গে এতই একাত্ম ছিলেন যে বড় সমস্যা সমাধানের জন্য অতি ক্ষুদ্রকায় পাখি হামিং বার্ডের কাছ থেকেও শিক্ষা নিয়েছিলেন। ওয়াঙ্গারি একটি গল্প বর্ণনা করে নিজের কাজের গুরুত্ব সম্পর্কে বলতেন এভাবে: ‘বনে আগুন লেগেছে, আর হামিং বার্ড ঠোঁটে পানি নিয়ে এক ফোঁটা করে ঢালছে। তা দেখে বৃহৎ প্রাণী হাতির মন্তব্য, হামিং বার্ড অনর্থক তার শক্তি ক্ষয় করছে। উত্তরে হামিং বার্ড বিনয়ের সঙ্গে বলে, আমার সাধ্যে যা কুলোয়, ততটুকুই আমি করছি।’ ওয়াঙ্গারি বলতেন, ‘আমি হাতি হয়ে বসে বসে পৃথিবী ধ্বংস হচ্ছে দেখতে চাই না, আমি হামিং বার্ড হয়ে আমার পক্ষে যতটুকু সম্ভব ততটুকু করে যাব।’
নারী অধিকার রক্ষার আন্দোলনে জড়িত হয়েই, নারীদের সমস্যার সমাধান করতে গিয়েই ওয়াঙ্গারির গাছ লাগানোর অপূর্ব চিন্তা এবং কাজ আমরা দেখেছি। তিনি নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেও পরিবেশ রক্ষা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছিলেন। তিনি মনোযোগ দিয়েছেন রাজনীতিতে, পাশাপাশি নারীদের রান্নার খড়ি জোগানোর কথা ভোলেননি।
Source :