আমরা কেন গাছ রক্ষা করব? গাছ রক্ষা করব নিজেদের জন্যে। গাছ আমাদের অক্সিজেন জোগায়, এটা সাধারণভাবে সবাই জানি। কিন্তু যেটা খুব বেশি লোক জানে না, সেটা হলো একটি পূর্ণবয়স্ক গাছ এক বছরে যে অক্সিজেন সরবরাহ করে, ওই অক্সিজেন ১০ জন পূর্ণবয়স্ক মানুষের এক বছরের প্রয়োজন মেটায়।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রফেসর তারকমোহন দাস ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে একটি গাছের অবদানকে অর্থমূল্যে পরিবর্তন করে দেখান, ৫০ বছর বয়সী একটি গাছের অর্থনৈতিক মূল্য এক লাখ ৮৮ হাজার ডলার। এই গাছ থেকে বছরে ২১ লাখ টাকার অক্সিজেন পায় মানুষ। বছরে প্রাণিসম্পদের জন্য প্রোটিন জোগায় এক লাখ ৪০ হাজার টাকার, মাটির ক্ষয়রোধ ও উর্বরতা বাড়ায় ২১ লাখ টাকার, পানি পরিশোধন ও আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ করে ২১ লাখ টাকার এবং বায়ুদূষণ রোধ করে প্রায় ৪২ লাখ টাকার।
গাছকাটা বা বৃক্ষনিধন নিয়ে আমাদের দেশে অনেক কথাবার্তা হয়। কিন্তু কাজ তেমন কিছু হয় না। ঢাকা শহরে উন্নয়নের নামে অহরহ গাছকাটা চলে, কিন্তু গাছ লাগানো হচ্ছে, এমনটা দেখা যায় না। মেট্রোরেল বানিয়ে নাগরিক সুবিধা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে সড়ক বিভাজিকায় রোপন করা গাছ কেটে পরিষ্কার করে ফেলা হয়েছে। কিন্তু শহরের কোথাও কি চলছে গাছ রোপনের উদ্যোগ? আসলে আমাদের দেশে প্রচুর গাছ তো, তাই দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা না বোঝার মতো গাছ থাকতে গাছের উপকারিতা বুঝতে পারছি না আমরা। হতো সৌদি আরবের মতো মরুভূমির দেশ, তাহলে হয়তো বুঝতাম।
সৌদিরা সেটা বুঝেছে হয়তো। শুধু তেল বেচে যে বেশিদিন ভাত জুটবে না নিয়ত পরিবর্তনশীল বিশ্বপরিস্থিতিতে, তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। তাই বিকল্প সম্পদ বাড়ানোর তোড় জোড় শুরু করেছে। তাছাড়া বিশ্ব উষ্ণায়নের যুগে অক্সিজেনের সরবরাহ না বাড়লে যে দমবন্ধ হয়ে মারা যেতে হবে, সেটাও রয়েছে তাদের মাথায়। তাই দেশটিতে গাছ কাটার বিরুদ্ধে কঠোর সাজার কথা ঘোষণা করা হয়েছে।
সৌদি আরবের পাবলিক প্রসিকিউশনের এক টুইটে বলা হয়, গাছ, গুল্ম বা গাছের ছালবাকল তুলে ফেলা বা পাতা ছেঁড়া, চারাগাছ মাটি থেকে উপড়ে ফেলা এবং গাছের গোড়া থেকে মাটি সরিয়ে নেয়াসহ এ ধরনের কাজকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে। অপরাধীকে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ড এবং ৩ কোটি রিয়াল জরিমানা করা হবে। দ্য আরব নিউজে এ বিষয়ে এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা সৌদি আরবের ভিশন-২০৩০ বাস্তবায়নের একটি পদক্ষেপ। দেশটি আগামী এক দশকের মধ্যে পরিবেশের ভারসাম্যে একটা স্থিতাবস্থা আনতে চায়।
গাছ কাটলে শাস্তির বিধান যে আমাদের দেশেও নেই, তা নয়। ২০১২ খ্রিস্টাব্দে এই বিষয়ক একটি বিল সংসদে পাঠানো হয়েছিল। বিলটিতে প্রস্তাব করা হয়েছিল, সরকারের অনুমতি ছাড়া বন, সড়কের পাশের ও পাবলিক প্লেসের গাছ কাটলে সর্বোচ্চ তিন মাসের কারাদণ্ড অথবা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে। তবে সেটার ফল কী হয়েছে, তা কখনোই স্পষ্ট হয়নি। অন্তত এখনো যে হারে গাছকাটা চলে, মনে হয় না তাতে কোনো কাজ হয়েছে। ওই বিলটিতে নানা শর্ত টর্তও ছিল। ওসব শর্তের ফাঁক ফোকরে গাছকাটার অনেক সুযোগও রয়েছে।
এভাবে আইন করে গাছকাটা বন্ধ করা খুব সহজ ব্যাপার নয়। গাছের প্রতি মানুষের মমতা সৃষ্টির কাজটা করতে হবে সবার আগে। দুই একটা কর্মসূচি পালন করে সে মমতা তৈরি করা সম্ভব নয়। এ জন্য চাই নিবিড় সামাজিক আন্দোলন, মানুষের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ও তা নিশ্চিত করা এবং তার সঙ্গে প্রশাসনিক নজরদারি তো চাই-ই।
মাসুদ আনোয়ার (সাংবাদিক, অনুবাদক এবং কলামনিস্ট)